সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির মূর্তিগুলো যুগ যুগ ধরে যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো সমগ্র দ্বীপটিকে আগলে রেখেছে যাতে এখানকার সত্য রূপটি বহির্জগতের মানুষের কাছে কোনোদিনই প্রকাশিত না হয়। রহস্য যত ঘনীভূত হতে থাকে বিশ্বের মানুষের কাছে দ্বীপটির আকর্ষণ ততই বাড়তে থাকে। এই আকর্ষণেই নরওয়ের প্রখ্যাত প্রত্নতাত্বিক থর হেয়ারডাল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার দ্বীপে এসে উপস্থিত হন। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তিনি দেখলেন প্রায় হাজারখানেক মূর্তি দ্বীপটির বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে। এগুলির উচ্চতা এক মিটার থেকে একুশ মিটার পর্যন্ত। এদের মধ্যে কিছু কিছু ভেঙে গেছে, কিছু কিছু অর্ধসমাপ্ত। দ্বীপের ভেতরের মূর্তিগুলো ইতস্তত দেখা গেলেও সমুদ্রতটের মূর্তিগুলো কালের প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে সারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বীপের প্রাচীন আদিবাসীরা মৃতদেহ সৎকার করতে বড়ো বড়ো পাথরের ব্লক কেটে তৈরি বেদীর উপর মৃতদেহ ফেলে রাখত যতদিন সেটা কঙ্কালে পরিণত না হত। এরপর এটিকে মাটি চাপা দিয়ে কবর দিত। পাথরের এই ব্লকগুলো লম্বায় প্রায় দশ মিটারের মতো হত। এরকম বেশ কিছু কবরের নিদর্শন ঐ দ্বীপে পাওয়া গেছে। এই স্মৃতিস্তূপগুলোর স্থানীয় প্রাচীন নাম ‘আহু’। অনেকে মনে করেন মৃতের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যেই দ্বীপের প্রাচীন আদিবাসীরা এই দানবীয় মূর্তিগুলো তৈরি করেছিল।
দক্ষিণ আমেরিকার চিলি উপকূল থেকে প্রায় আড়াই হাজার মাইল পশ্চিমে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলি ছোটো ছোটো দ্বীপ। পলিনেশিয়ার পূর্বদিকে অবস্থিত দ্বীপগুলোর সুদূরতম দ্বীপটির নাম ‘ইস্টার দ্বীপ’। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা এই দ্বীপটির আয়তন ১৬০ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে লোকবসতি খুবই কম, মাত্র ১৬০০ জনের মতো। দ্বীপটিতে আছে তিনটি আগ্নেয়গিরি – রানো রারাকু, ম্যঙ্গাটেরেভাকা ও কাটিকি। আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে দ্বীপটির উৎপত্তি। তাই দ্বীপটিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আগ্নেয়শিলা। এখানকার সবথেকে বড়ো বিস্ময় হল আগ্নেয়শিলায় তৈরি দৈত্যাকৃতির সব মূর্তি। সমুদ্রতট থেকে পাহাড়ের কোলে প্রায় সর্বত্রই অতন্দ্র প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সার দিয়ে। এগুলো কাদের মূর্তি? তৈরিই বা করেছিল কারা? পৃথিবীর মানুষ, না গ্রহান্তরের জীব? এরকম হাজারো প্রশ্ন বারবার উঁকি মেরেছে মানুষের মনে। রহস্যে ঘেরা এই দ্বীপটির হাতছানিতে অভিযাত্রী দল তাই বারবার ছুটে গেছে সেখানে।
স্থানীয় আদিবাসিদের ভাষায় দ্বীপটির নাম ‘তে পিতো ওতে হনুয়া’ অর্থাৎ বিশ্বের নাভিমূল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছে অবশ্য এর পরিচিতি ‘ইস্টার আইল্যান্ড’ নামে। এই নামকরণটিও হয়েছিল প্রায় তিনশ বছর আগের একটি অভিযান থেকে। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডমিরাল জ্যাকব রোগেভিনের নেতৃত্বে একদল ইউরোপীয় অভিযাত্রী নিয়ে একটি জাহাজ এই দ্বীপটিতে যেদিন পৌঁছয় সেদিনটি ছিল ইস্টার ডে। তাই দ্বীপটির নাম রাখা হয়েছিল ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। ইউরোপীয় অভিযাত্রী হিসেবে এরাই প্রথম এই দ্বীপে পা রেখেছিলেন।
জনবিরল এই দ্বীপটির প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই দৈত্যাকার পাষাণমূর্তিগুলো আজও বিস্ময় জাগায়। বহু শতাব্দী ধরে এর নির্মাণকৌশল রহস্যাবৃত ছিল। ফলে এগুলিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছিল নানারকম কাল্পনিক গল্প। রহস্যের উদ্ঘাটন করতে অনেক অভিযাত্রীই পাড়ি দিয়েছিলেন এই দ্বীপে। এদের মধ্যে স্পেনীয় নাবিক ফিলিপ গঞ্জালেস্ এবং ফরাসী অ্যাডমিরাল জা ফ্রাসোয়া লা পেরোজ-এর নাম উল্লেখযোগ্য। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে গঞ্জালেস্ আর ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে পেরোজ এই দ্বীপে পাড়ি দেন। কিন্তু কেউই এই দানবীয় মূর্তির রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি।
বর্তমানে দ্বীপটিতে সবুজের অভাব থাকলেও মনে করা হয় একসময় এখানে ঘন জঙ্গল ছিল। বার বার অগ্নুৎপাতের ফলে তা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। দ্বীপের চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে আগ্নেয়শিলা। মূর্তিগুলো তৈরি করতে এই পাথরই ব্যবহৃত হয়েছে। কোনও মূর্তির মাথায় লম্বা লম্বা চুড়ো দেখতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে লম্বাটি প্রায় ২.৮ মিটার উঁচু। ওজন ১১.৫ টনের মতো। এগুলো লাভাপ্রস্তর দিয়ে তৈরি হওয়ায় দেখতে কিছুটা রক্তিম।
মূর্তিগুলো তৈরির জন্য ব্যবহৃত কিছু যন্ত্রপাতির হদিস পাওয়া গেছে ‘রানো রারাকু’র খাদের মধ্যে। এছাড়াও ৩৯৪টি অসম্পূর্ণ মূর্তিও পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার এবং ওজন ২০০ টনের কাছাকাছি। মূর্তিগুলোকে তৈরি করা হত শোয়ানো অবস্থায়। তাই খাদের মধ্যে অর্ধসমাপ্ত মূর্তিগুলোর প্রায় সবক’টিই শোয়ানো অবস্থায় রয়েছে। এই অসম্পূর্ণ মূর্তিগুলো দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, এই অঞ্চল ছিল মূর্তি তৈরির কারখানা। প্রায় সমাপ্ত মূর্তিগুলোকে রানো রারাকুর খাদ থেকে নিচে নামানো হত দড়ি দিয়ে বেঁধে পাথুরে ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে। হিবিস্কাস (Hibiscus) জাতীয় একরকম উদ্ভিদের আঁশ দিয়ে তৈরি হত এই দড়ি। খাদের মাথায় পাহাড়ের গায়ে প্রায় এক মিটার গভীর কয়েক জোড়া ছিদ্রের খোঁজ পাওয়া গেছে। এই ছিদ্রগুলো নিচের দিক থেকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। অনুমান করা হয়, মূর্তিগুলো নামানোর সময় দড়ি বাঁধার জন্য এই ছিদ্রগুলো ব্যবহার করা হত। এছাড়াও পাথর কেটে বানানো কিছু খুঁটির সঙ্গেও দড়ি বাঁধা হত।
পাহাড়ের পাদদেশে মাটি খুঁড়ে কতগুলো গর্ত করা হত। মূর্তিগুলোকে সেখানে নামিয়ে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে অবশিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করা হত। পাহাড়ের তলদেশে এরকম ১০৩টি স্ট্যাচু মাটির ভেতর আবক্ষ প্রোথিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনও এক অজানা কারণে এগুলো সম্পূর্ণ করে সমুদ্রতটে আর স্থানান্তরিত করা হয়নি।
এই বিশাল বিশাল মূর্তিগুলোকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সমুদ্রতট অবধি স্থানান্তরিত করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। অধ্যাপক উইলিয়াম মুলয়-এর মতে মূর্তিগুলোকে স্থানান্তরের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কাঠের দোলায় বা স্লেজ জাতীয় একধরনের গাড়ি ব্যবহার করা হত। পরবর্তীকালে ডঃ ভ্যান টিলবার্গ দোলায় চাপিয়ে মূর্তি স্থানান্তরের ঘটনাকে সমর্থন করেননি। তাঁর মতে অধিকাংশ মূর্তির গড়ন এই ধরনের পরিবহন-ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ইস্টার দ্বীপে ঘুরে আসতে এখানে ক্লিক করুন
COMMENTS (1)
Obak information… thanks