জুলু প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ লোকের একটি জনগোষ্ঠীর নাম যাদের বসবাস আফ্রিকা মহাদেশে। তাদের মূল বসতি হল দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশে (Kwa-Zulu Natal)। তারা জুলু ভাষায় কথা বলে যা বান্টু ভাষা পরিবার থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তবে জুলু ভাষার সবচেয়ে সমসাময়িক পূর্বপুরুষ হল উনগুনি (Nguni) নামক একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে জুলুদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তখন কৃষ্ণকায় জুলুদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হত। কিন্তু বর্তমানে তারা সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত এবং তাদের অধিকার বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে।
জুলুদের উৎপত্তি উত্তর কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে। জুলু জাতির জনক হিসেবে অভিহিত করা হয় জুলু কান্টোমভেলাকে যিনি ১৭০৯সালে জুলু জাতির গোড়াপত্তন করেন। তখন এই প্রদেশটিতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উনগুনি জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বসতি ছিল যাদের অপর নাম হল ইমজি।
শাকা ছিলেন জুলুদের প্রধান নেতা সেনযানগাকোনার (Senzangakona) অবৈধ সন্তান। তিনি ১৭৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সেনযানগাকোনা সে এবং তার মাকে নির্বাসনে পাঠায় এবং তারা উদ্বাস্তু হিসেবে থেথোয়াদের (Mthethwa) আশ্রয় লাভ করে। শাকা থেথোয়া প্রধান ডিংগিশোইয়োর (Dingiswayo) অধীনে যুদ্ধ করেন। সেনযানগাকোনার মৃত্যুর পর ডিংগিশোইয়ো জুলুদের প্রধান হবার জন্য শাকাকে সাহায্য করে এবং শাকা প্রধান হন। তারা দুজনে সর্বদাই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। কিন্তু এক যুদ্ধে রাজা জোইদে (Zwide) কর্তৃক ডিংগিশোইয়ো নিহত হয়। এরপর থেথোয়ারা শাকাকে রাজা মেনে নেয় এবং তারা সবাই জুলু নামধারণ করে। শাকাকে হত্যা করে তার পর সিংহাসনে আরোহন করে তারই সৎ ভাই ডিনগান। ডিনগান শাকার অপর সৎ ভাই উমলাঙ্গানারসহযোগিতা নিয়েছিল।
ডিনগান এবং রেটিফের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে ডিনগান টুগেলা নদীর দক্ষিণ থেকে জিমভুবু নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ভুরত্রেকারদের অধীনত্বে ছেড়ে দেয়। ডিনগানের সেনাবাহিনী কাছাকাছি স্থানে বসবাসকারী প্রায় ৫০০ ভুরত্রেকার নারী পুরুষের একটি দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এই ঘটনার স্থানটিকে বর্তমানে উইনেন (Weenen: ডাচ ভাষায় যার অর্থ: কাঁদা) নামে অভিহিত করা হয়। এরপর জীবিত ভুরত্রেকাররা আন্দ্রিস প্রেটোরিয়াসকে নতুন নেতা নির্বাচিত করে। ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে ৪৭০ জন ভুরত্রেকারদের একটি জনপদে হামলা চালায় যা ব্লাড রিভার যুদ্ধহিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রেটোরিয়াসের নোতৃত্বে ভুরত্রেকারদের কাছে ডিনগানের বাহিনী সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এই যুদ্ধের পর ডিনগান তার রাজকীয় সকল সম্পত্তি পুড়িয়ে দিয়ে উত্তরের দিকে পালিয়ে যায়। এই সুযোগে ডিনগানের সৎ ভাই পান্ডা ১৭,০০০ সৈন্যের একটি দল নিয়ে স্বদেশ ত্যাগ করে এবং প্রেটোরিয়াস ও ভুরত্রকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ডিনগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ডিনগান আধৃনিক সোয়াজিল্যান্ড সীমান্তের নিকটে নিহত হয়। এরপর পান্ডা জুলু জাতির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
১৮৪৩ সালে পান্ডা রাজ্যের মধ্যে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত একটি শ্রেণীগোষ্ঠীকে রাজ্য হতে অপসারণের আদেশ দেয়। এতে প্রচুর মানুষ হতাহতের শিকার হয় এবং অনেক শরণার্থী পার্শবর্তী রাজ্যসমূহে আশ্রয় নেয়। ১৮৫৬ সালে সোয়াজিল্যান্ড পান্ডার দখলে আসে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগেই পান্ডার দুই পুত্র কেটেওয়্যায়ো এবং উমবেলাজি সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। ১৮৫৬ সালে চূড়ান্ত রকমের যুদ্ধে উমবেলাজি নিহত হয় এবং কেটেওয়্যায়ো অবৈধভাবে পিতার শাসনভার পরিচালনা করতে থাকে। ১৮৭২ সালে পান্ডার মৃত্যুর পর কেটেওয়্যায়ো শাসনক্ষমতা দখল করে।
১৮৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে ইংরেজ প্রতিনিধিদল কেটেওয়্যায়োর প্রতিনিধিত্বকারী ১৪ জন গোষ্ঠী প্রধানের নিকট একটি চরমপত্র পেশ করে। চরমপত্রের শর্তাবলি ছিল অযৌক্তিক এবং কেটেওয়্যায়োর কাছে সেগুলোকে অগ্রহনযোগ্য মনে হয়। এ থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইংরেজরা ডিসেম্বরের শেষদিকে থুকেলা নদী পার হয়ে কেটেওয়্যায়োর সাম্রাজ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৮৭৯ সালের প্রথম দিকে যুদ্ধের সূচনা হয়। প্রথম পর্যায়ে ২২ জানুয়ারি তারিখে সংঘটিত ইসান্ডলোয়ানার যুদ্ধে (Battle of Isandlwana) জুলুরা ইংরেজদের পরাজিত করে। কিন্তু ৪ জুলাই তারিখে সংঘটিত উলুন্ডির যুদ্ধে জুলুদের পরাজয়ের মাধ্যমে অ্যাংলো-জুলু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। জুলুদের পরাজয়ের এক মাস পর কেটেওয়্যায়োকে আটক করা হয় এবং ইংরেজরা তাকে কেপ টাউনে নির্বাসিত করে। পরে তিনি আবার জুলুল্যান্ডে ফিরে যাবার অনুমতি পান। পরবর্তীতে কেটেওয়্যায়ো উলুন্ডিতে ১৩ জন পাতিরাজার একজন উজিমভেবু কর্তৃক আক্রান্ত হন। এই যুদ্ধ বোজাতির ভাড়াটে যোদ্ধারা উজিমভেবুর সাথে যোগ দেয়। এতে কেটেওয়্যায়ো আহত অবস্থায় পলায়ন করে। ১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেটেওয়্যায়ো মৃত্যুবরণ করে। তার পুত্র ডিনিজুলু পরবর্তী রাজা হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়; তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।
ডিনিজুলু একটি বিশাল অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ঘটনায় বৃটিশরা সতর্ক হয়ে য্য় এবং একে সহজচে মেনে নিতে পারেনি। ১৮৮৭ সালে তারা জুলুল্যান্ড দখল করে নিয়েছিলো। এসব যুদ্ধের সাথে ডিনিজুলু সম্পৃক্ত ছিল এবং এর ফলে তাকে আটক করা হয় এবং বিশ্বাসঘাতকতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং গণ সহিংসতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮৮৯ সালে ডিনিজুলুকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল।
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য