রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ এর আরিবি পরিভাষা সাওম। সিয়ামের বহুবচনের সাওম। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, কঠোর সাধনা, অবিরাম প্রচেষ্টা, আত্মসংযম ইত্যাদি। রোজা ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত। যেমন, নামাজ, হজ, যাকাত এর মধ্যে রোজা অন্যতম ইবাদত। হজ একটি ইবাদত, কিন্তু হজ সবার জন্য নয়। হজ কেবল স্বচ্ছল এবং সুস্থ ব্যক্তির জন্য ফরজ। কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে কিছুটা কঠোরতা আছে। যে কারণে প্রত্যেক নর-নারীর ওপর রমজান মাসে রোজা রাখা অবশ্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়, ফরজে আইন। যদি কেউ সাওম পালন না করে তবে সে কবিরা গুনাহের অধিকারী হবে। আর কেউ যদি রোজাকে আস্বীকার করে সে কাফের হয়ে যাবে।
ইবাদত হিসেবে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম ও অতুলনীয়। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে রোজা এক অনিবার্য অপরিহার্য ইবাদত। মানুষের নৈতিক ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধানে রোজার ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
শরিয়তের দৃষ্টিতে রোজার সংজ্ঞা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিকের আভা পূর্বে ওঠার সময় থেকে রোজার নিয়ত করতে হবে এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যাবতীয় ইন্দ্রিয় তৃপ্তি হতে বিরত থাকার নাম রোজা। প্রত্যেক মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, বুদ্ধিমান নর-নারীর ওপর রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজে আইন। অন্য দিকে অসুস্থ ব্যক্তি, পর্যটক, দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা, বার্ধক্যগ্রস্ত দুর্বল ব্যক্তি, আল্লাহর পথে যুদ্ধে নিয়োজিত ব্যক্তির জন্য রোজা রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে যে কটি রোজা এসব কারণে পালন করা সম্ভব নয়, তা পরবর্তী সময়ে সুবিধামত এগারো মাসের যে কোনো সময় পালন করতে হবে। অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী হলে কিংবা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার কারণে রোজা রাখা সম্ভব না হলে, রমজান মাসে কোনো গরিব ব্যক্তির আহারের ব্যবস্থা করা, কিংবা প্রায়শ্চিত্তমূলক দান-খয়রাত দেয়া। কিন্তু সে যদি গরিব হয়, তার জন্য এ ব্যাপরে শিথিলতা আছে।
রমজান মাসে সেহেরির নির্দিষ্ট সময় নির্ধরণ করা হয়ে থাকে। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে যে, সেহেরির মাত্র আর দশ মিনিট বাকী। দশ মিনিট পরই ফজরের আজান দিয়ে থাকে। এরপর রোজা রাখার জন্য ভোর রাতে আর আহার করা যাবে না বলে সকলেরই ধারণা। আজান দেয়ার পরও রাত্রি অনেক থাকে। মূলত এ সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব সীমিত। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা সম্ভব না হয়, আজানের পরও আহার করে রোজা রাখা যাবে। পূর্বাকাশে রক্তিম আভা না দেখা পর্যন্ত। যারা নিয়মিত রোজা রাখেন, নামাজ আদায় করেন, একটি রোজা ভঙ্গ তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক ব্যাপার। সেক্ষেত্রেই কেবল ফজরের আজান দেয়ার পরও রোজা রাখার জন্য আহার করা যাবে।
হযরত মোহাম্মদ (স:) বলেছেন, রোজা একটি ঢাল স্বরূপ। সুতরাং রোজা পালনকারী কোনো অশোভন উক্তি করবে না। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকআম্বরের চাইতেও অধিক সুগন্ধিময় মনে হয়। যিনি একমাত্র আল্লাহর খুশির জন্য পানাহার ও অন্যান্য লোভনীয় জিনিস গ্রহণে বিরত থাকেন রোজা কেবল তারই জন্য।’
রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের মধ্যে নৈতিক শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং গুরুত্ব এই যে, দহনের মাধ্যমে দুস্কার্য, কুচিন্তা, কুইচ্ছা প্রভৃতির নিরসন করা। সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য চিন্তা, কুকথা এবং সকল প্রকার অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকে।
রোজা শুধু আত্মিক উৎকর্ষ সাধন করে না, দৈহিক উৎকর্ষ সাধনেও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। রমজান মাসে পরিমিত আহার করার ফলে পাকস্থলির পরিপক্ক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অজীর্ণ, অগ্নিমন্দা প্রভৃতি রোগ হতে মুক্তি লাভ করা যায়। রমজান মাসে নিয়ন্ত্রিত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করার ফলে মানবদের মেদ ও চর্বি জাতীয় উপাদানের আধিক্য হ্রাস পায়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে রোজা রাখা হয়, সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না অনেক ক্ষেত্রে। অনেক পরিবারে দেখা যায়, রোজার মাসে ইপ্তারিতে যে ভোজন বিলাসের আয়োজন করা হয়, তাতে অনেক সময়ই অসুস্থ হওয়ার আশংকা থাকে। এ কারণে রোজা রাখার উদ্দেশ্য ব্যহত হতে পারে।
রোজার মাসে গরিবকে যাকাত প্রদান করা হয়। এ বছর প্রত্যেকের জন্য কত টাকা যাকাত প্রদান করতে হবে এটা সরকারীভাবে ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো ধনী পরিবার গরিব মহিলাদের কাপড় বিতরণ করে থাকে। কাপড় বিতরন করার সময় একখানা কাপড় পাওয়া আশায় লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হয়ে মারা গেছে, এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। যাকাত প্রদান যদি কোনো গরিব দু:খী মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, সে যাকাত দেয়ার বিষয়টি অর্থহীন হয়ে যাবে। বরং এই মৃত্যুর জন্য তাকে পাপের ভাগী হতে হবে, এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
রোজার মাস আসতে না আসতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। চাল ডাল পিঁয়াজ, তেল এ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পিছনে বড় রকমের সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সব সিন্ডিকেট উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এসব জিনিস পত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অধিক মুনাফা করে থাকেন। কোনো ব্যক্তি রোজা রেখে এরকম অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যদি জড়িত থাকেন, তার রোজা, নামাজ অর্থাৎ কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। আমরা প্রতিবছরই লক্ষ্য করে থাকি যে সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে অনেকে রোজা রাখেন এবং সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ উৎসব পালন করে থাকেন। কখনো কখনো সৌদি আরবে ঈদ উৎসব পালন করার এক বা দুদিন পর আমাদের এখানে ঈদ উৎসব পালন করা হয়। এর আগে চাঁদ দেখা কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়। এ বিষয়টিকে গ্রাহ্য না করে তারা এক বা দুদিন আগে রোজা রাখে। এটা চাঁদপুর জেলার ইছাহাক মাওলানা নামে জনৈক ইমাম এ প্রথা চালু করেন প্রায় একশ’ বছর আগে। এবং সেভাবে চাঁদপুরের কয়েকটি গ্রামে প্রথম শুরু হয়। বর্তমানে এ প্রথা বিভিন্ন জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এমন কি রাজধানীর ঢাকার কোনো কোনো স্থানে সরকার কর্তৃক ঘোষণা দেয়ার এক বা দুদিন আগে তারা রোজা রাখেন এবং ঈদ উৎসব পালন করেন। এটা যে দেশদ্রোহিতার সামিল হতে পারে এ বিষয়ে সরকার পর্যন্ত অচেতন হয়ে আছে। এটা বন্ধ করা উচিত।
এটা সমগ্র আলেম সমাজের জানার কথা যে ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে দুটো। একটি সূর্যভিত্তিক এবং অন্যটি চন্দ্র ভিত্তিক। সূর্যভিত্তিক ইবাদত হচ্ছে নামাজ। সৌদি আরবের চেয়ে আমাদের দিনের ব্যবধান তিন ঘন্টার উপরে। আমাদের এখানে ঘড়িতে যখন সকাল আটটা বাজে, সৌদি আরবে তখন ফজরের নামাজ আদায় করে। সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে কিন্তু সকাল আটটায় সময় ফজরের নামাজ আদায় করে না। চন্দ্রভিত্তিক ইবাদত হচ্ছে রোজা। যেহেতু চন্দ্র সৌদি আরবে আমাদের আগে দেখা যায়, আমাদের এখানে পরে দেখা যায় বলে আমরা একদিন বা দুদিন পরে রোজা রাখতে শুরু করি। পবিত্র কোরান বা হাদিসের কোথাও আছে সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোজা বা ঈদ উৎসব পালন করতে হবে? কাজেই সরকারের উচিৎ সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোজা রাখা থেকে তাদের বিরত রাখা। নতুবা একদিন এ সিস্টেম সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তারা ইসলামের কল্পিত চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে একদিন সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে।
COMMENTS