অন্যান্য

বিস্ময়কর নগরী -যা আজো রহস্যময়

By Green Desk

May 04, 2018

পেরুর মাচুপিচু হচ্ছে ইনকা জাতির প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বিস্ময়কর নগরীর নাম। প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক মাচুপিচু দেখতে ছুটে যায় পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কুসকো শহরে। এখানেই অবস্থিত মাচুপিচু সভ্যতা। ধারণা করা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইনকা নগরী মাচুপিচু তৈরি করা হয়। পেরুর দক্ষিণ-পশ্চিমে আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত এই শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে ইনকা সভ্যতা। নানা মায়া কাহিনি প্রচলিত রয়েছে ইনকাদের নিয়ে। তাদের রাজ্যের পথের ধুলোয়ও নাকি সোনার গুঁড়ো ছিল।

ইনকা সাম্রাজ্য দুই হাজার পাঁচশ মাইলব্যাপী বিস্তৃত ছিল। এখানে প্রতিটি মানুষ এমনকি অন্ধ, খোঁড়া, মূক, বধির, বৃদ্ধ  প্রতিটি লোক সম্মানের সঙ্গে তার শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত শস্য সমানভাগে উপভোগ করত। আধুনিক পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র আজও সে উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। মাচুপিচু শব্দের অর্থ প্রাচীন পর্বত। শব্দটি মূলত আমেরিকান প্রাচীন জাতি কেচুয়াদের ব্যবহৃত শব্দ। মাচুপিচু শুধু পর্যটক নয়, বছরের পর বছর আকৃষ্ট করেছে প্রত্ন-তত্ত্ববিদদেরও। মাচুপিচু নগরীটি কোনো ধ্বংসাবশেষ নয় বরং একেবারে অক্ষত অবস্থায় আছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এটি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের কাছে ইনকা সভ্যতা বলতে মাচুপিচুরই পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। মাচুপিচুর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৫০০ ফুট উচ্চতায়।

অধিকাংশ সময় মাচুপিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে ‘মেঘের দেশের নগরী’ বলা হয়। অনেক সময়ে এর ওপর দিয়ে চলাচল করা বৈমানিকদেরও এটি চোখে পড়ে না। মাচুপিচুর সৌন্দর্যের মূল আকর্ষণ হলো আশপাশের ঘন সবুজ বন। অনেকেই বিশ্বাস করেন ‘মাচুপিচু’ অত্যন্ত পবিত্র একটি জায়গা। আবার অনেকের বিশ্বাস এই শহরে ইনকা সম্রাট বসবাস করতেন। কারো আবার ধারণা এখানে ছিল ইনকাদের দুর্গ।

উপকথা অনুযায়ী প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কোস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরিদের অধীনে আন্দেস পর্বতমালার অন্য জাতি-গোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্তে বিস্তৃত করে। পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে, ‘পৃথিবী কাঁপানো মানুষ।’ তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক কেন্দ্র ছিল কোস্কো শহর।

পেরুর পাহাড়ি এলাকায় ১৩০০ শতকের দিকে ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়। বর্তমান ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়াও ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইনকা জাতি বেশ বুদ্ধিমান ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইনকাদের রাজত্বে কখনো না খেয়ে মরার কোনো ঘটনা ঘটেনি। যতদূর জানা যায়, ইনকা সম্রাটই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তার রাজ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চুরি করলে অপরাধীর শাস্তি সরাসরি এবং প্রচলিত সাধারণ নিয়মে হবে না। আগে তদন্ত করে দেখতে হবে যে, চুরিটা কোন পর্যায়ের; স্বভাবগত নাকি অভাবের দরুন। স্বভাবগত হলে তাকে রোদে শুকিয়ে মারতে হবে, অভাবের দরুন হলে সে যে এলাকার মানুষ সেই এলাকার শাসন কর্তাকে রোদে শুকিয়ে মারতে হবে। কেননা তার শাসনেই এই অভাবের জন্ম। পৃথিবীতে এমন অদ্ভুত দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি।

ইনকা সভ্যতায় ধর্মভিত্তিক কুসংস্কারের কোনো শেষ ছিল না। সূর্য দেবতা ‘ইনটি’ ছিল ইনকা ধর্মের মূল কেন্দ্র। তবে এর পাশাপাশি তারা স্থানীয় অনেক দেব-দেবীকে মেনে নিয়েছিল। প্রজারা এসব দেব-দেবীর পূজা করত, যারা ‘হুয়াকাস’ নামে পরিচিত ছিল। যদিও ইনকারা মেক্সিকোর অ্যাজটেকদের মতো রক্তপিপাসু ছিল না, তবুও তারা নরবলি পছন্দ করত। বিশেষ করে ‘কাপাকচা’ নামের বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশুদের বলি দেওয়া হতো। দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করার আগে ইনকারা কিভাবে তাদের সন্তানদের মোটাতাজা করত, কিছু মমি আবিষ্কারের মাধ্যমে তার নির্মম প্রমাণ পাওয়া গেছে।

প্রাচীন ইনকা সভ্যতার নিকটবর্তী ‘লুলাইলাকো’ নামের একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সংরক্ষিত ৫০০ বছরের পুরনো মমির চুল পরীক্ষার মাধ্যমে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেছে। সেখানে ‘লুলাইলাকোর কুমারী’ নামে পরিচিত ১৫ বছর বয়সী এক বালিকা এবং ‘লুলাইলাকোর বালক’ নামে সাত বছর বয়সী এক বালকের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। মমিকৃত দুটি দেহের সঙ্গে ছয় বছর বয়সী আরেকটি ছোট মেয়ের মমির সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু পাহাড়ের দেবতাদের তুষ্ট করতেই তাদের বলি দেওয়া হতো না, বরং একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কে বিজিতদের মনে ভয় ও সম্মান ঢুকিয়ে দেওয়াও এর একটি উদ্দেশ্য ছিল।

মাচুপিচু শহরটির ১৪০টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ (আবাসিক ভবনগুলো খড়ের ছাউনি দেওয়া ছিল)। মাচুপিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিঁড়ি যার মধ্যে কিছু কিছু একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরের খ- কুদে তৈরি করা হয়েছে। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝরনা, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব মূলত সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, এই সেচ ব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি পবিত্র ঝরনা থেকে পানি প্রতিটি বাড়িতে সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মিত হয়, কিন্তু এর ১০০ বছর পর ইনকা সভ্যতা যখন স্পেন দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ বছর অজ্ঞাত থাকার পর ১৯১১ সালে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম মাচুপিচুকে আবার লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসেন। ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই তিনি বৈজ্ঞানিক অভিযানে মাচুপিচু এসে পৌঁছান। খুঁজে পান ইনকা সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া এই নগরী। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জার্নালে তিনি তার অভিযান এবং আবিষ্কারের কথা জানান। তারপর থেকে মাচুপিচু পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। এটিকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে এটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বর্তমান বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।