গড়ে তুলুন বই পড়ার অভ্যাস

ভাল লাগলে শেয়ার করে সবাইকে জানান

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আর অ্যান্ড্রয়েড ফোন তথা যাবতীয় তথ্য-প্রযুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে একটা অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে এগুলো মানুষের মনোসংযোগের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। যেকোনো বিষয়ে আগে মানুষ যেভাবে গভীর মনোযোগ দিতে পারত, এখন ‘স্ক্রলিং’ আর ‘সার্চ’ অপশনের যুগে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আগের মতো আর মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগে অলস দুপুরে বালিশে হেলান দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই হাতে নিয়ে পুরোটাই হয়তো এক টানে পড়ে উঠতেন, এখন আধা পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ পড়ার দরকার হলে হয়তো দু-এক লাইন পড়েই বাদ দিয়ে দেয়া হয়।

অর্থাৎ একটা বিষয় স্বীকার করতেই হবে, আমাদের সবারই বইপত্র বা খবরের কাগজের প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়ার অভ্যাস একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সবকিছুই আমরা এখন টুইটারের ১৬০ ক্যারেক্টারের মতো চাওয়া শুরু করেছি, সবকিছুই যেন দুই-তিন লাইনেই হওয়া চাই। দুই-তিন লাইনের বেড়া ছাপিয়ে একটা অনুচ্ছেদ হয়ে গেলেই আমাদের পড়তে অনীহা চলে আসে।

প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় সব এনে দেয়াতে আমাদের এই অভ্যাস রীতিমতো স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আগে যেটা আধা ঘন্টা বইপত্র ঘেঁটে বের করতে হতো সেটা এখন গুগল সার্চবারে একটা সার্চ দিলেই চলে আসছে। ফলে সাহিত্যরসের আস্বাদনের কথা নাহয় বাদই দেয়া হলো, একাডেমিক ব্যাপারেও এখন বইপত্র পড়ার অভ্যাস থাকছে না।

এতে যে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তার হিসেব এখন হয়তো মিলবে না। বিনোদনের ১০১টা মাধ্যম হাতের কাছে থাকাতে গল্পের বই খোলা হয় না। কিন্তু সাহিত্যে নিজের মননশীলতা গঠনে অত্যন্ত দরকারী একটা জিনিস, অর্থাৎ সাহিত্য জিনিসটা অনেকটা মনের খাদ্যের মতো। মনকে তার চাহিদানুযায়ী খাদ্যরস, প্রাণরসের যোগান না দিলে মন বাঁচে না, মরে গিয়ে মানুষ তখন পরিণত হয় একটা যন্ত্রে।

আবার একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দিক দিয়েও কিছুটা চিন্তা করা দরকার। মনে করে দেখুন তো সর্বশেষ কবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট অথবা কোম্পানির প্রতিবেদন তৈরীর জন্যে বইপত্র ঘেঁটেছেন। বইপত্র না ঘেঁটে শুধু ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে কাজ সেরে ফেলেন অনেকেই। সেটা করলেও হয়তো ঠিক ছিলো, কিন্তু কোনো গবেষণা ছাড়াই বলে দেয়া যায় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা ‘কপি-পেস্ট’ এ গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ মৌলিকত্ব বলে কোনো ব্যাপারই আর থাকছে না।

আমাদের মনের এই অগভীরতা আর এই অনুৎপাদনশীল আচরণের মূলে রয়েছে আমাদের বই না পড়ার অভ্যাস। সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ না থাকায় মনের ভেতরটা শুকিয়ে গিয়ে ধু ধু বালুচর অবস্থা। আর একাডেমিক পড়াশোনা শুধু ফটোকপি আর শিক্ষকদের দেয়া প্রেজেন্টেশন স্লাইড ছাপিয়ে নিয়ে কাজ চালানোতে একটা অস্পষ্ট জ্ঞান নিয়ে সেমিষ্টারের পর সেমিস্টার পার করেছি আমরা। এতে যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে তা টের পাওয়া যায় বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গেলে এবং কর্মক্ষেত্রে। বিদেশে উচ্চশিক্ষারত কিংবা বিষয়ভিত্তিক কাজে জড়িত অগ্রজ বড় ভাইদের সাথে আলাপ করলে জানা যায়, এই অগভীর জ্ঞান নিয়ে কী কী ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়।

আরেকটি ব্যাপার আমাদের প্রত্যেকের উপলব্ধিতে আনা জরুরি, সেটা হলো ইন্টারনেটের সব তথ্যই নির্ভরযোগ্য নয়। সুতরাং যেনতেন কোনো সাইট থেকে তথ্য নিয়েই নগদে সেটা কাজে লাগিয়ে দেয়া কোনো সমঝদার মানুষের কাজ হতে পারে না। অনেকেই হয়তো এই সমস্যায় ভোগেন, কোনো অ্যাসাইনমেন্ট বা রিপোর্ট লেখার সময় ঠিক বুঝে উঠতে না পারা যে কী লিখব বা কিভাবে শুরু করব। প্রায় সব ক্ষেত্রেই যেটা হয় তা হলো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে তার নিজের কপিটা ধার করে নেয়া। অথচ এটা না করে আপনি লাইব্রেরিতে গিয়ে আধা ঘন্টা বা এক ঘন্টা সময় নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করলে হয়তো আপনার বন্ধুর করা রিপোর্টের থেকেও ভালো লিখতে পারতেন এবং সে ব্যাপারে আপনার জ্ঞানও হতো আরো স্বচ্ছ।

তাই বই পড়া অনেকদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। একটা প্রশ্ন প্রায় সবার মনেই আসে, বই না পড়ার এই অভ্যাস কিভাবে ভর করলো? এজন্য কি শুধু প্রযুক্তিই দায়ী। এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব পেতে বোধহয় বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় নামতে হবে। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের আগের প্রজন্ম অর্থাৎ আমাদের বাবা-দাদাদের আমলে বই পড়ার একটা সংস্কৃতি তো ছিলোই এবং সেটাকে উৎসাহিতও করা হতো। কিন্তু গত বছর ত্রিশ যাবৎ পড়াশোনার চাপ বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে অভিভাবকরা সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়াকে রীতিমতো নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা শুরু করেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাঠ্যপুস্তক বাদ দিয়ে বাজারি নোটপত্রকে গুরুত্ব দেয়াও শুরু হয়। আর এতেই হয়ে চলেছে এক অপূরণীয় ক্ষতি।

শিশুদের বই পড়তে উৎসাহ দিন; Source: tweetspeakpoetry

তাই মননশীলতা গড়াই হোক আর একাডেমিক জ্ঞানই হোক, বই পড়া সর্বদাই সফলতার মূল চাবিকাঠি। বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ও বিনিয়োগ গুরু ওয়ারেন বাফেট তাই বলেছেন,

“প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ পাতা পড়ুন। এভাবেই জ্ঞান আহরণ করতে হয়, যা অনেকটা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের মতো বেড়ে চলে। আপনারা সবাই চাইলে এভাবে এগোতে পারেন, কিন্তু আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি খুব কম মানুষই সেটা করবে।”

অর্থাৎ ওয়ারেট বাফেটও নিশ্চিত করেছেন যে, পড়ার উপদেশ অনেকেই দেবে, কিন্তু আসলে শেষপর্যন্ত সেটা মানবে খুব কম লোকই। পড়ার অভ্যাস নেই যাদের, তাদের একদমই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অল্প কয়েকটা ব্যাপার মাথায় রেখেই গড়ে তুলতে পারেন বই পড়ার অভ্যাস।

আপনি চাইলেই মাঝপথে পড়া বাদ দিতে পারেন

মনকে বিক্ষিপ্ত করে এমন জিনিস সরিয়ে ফেলুন

বর্তমান জমানায় মনকে বিক্ষিপ্ত করার উপাদানের কোনো অভাব নেই। স্মার্টফোন, টিভি, গেম ইত্যাদির আছে লম্বা তালিকা। বই পড়ার অভ্যাস করতে আপনাকে এসব জিনিস সরিয়ে ফেলতে হবে। নতুবা কোনো বইয়ের দু’পাতা পড়ার পরে মনে হবে, যাই, একটু টিভি দেখে আসি।

মনকে বিক্ষিপ্ত করে এমন উপাদান সরিয়ে রাখুন, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও; Source: ndtv

এ প্রসঙ্গে একটা মজার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কথা বলা যেতে পারে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলোজি ডিপার্টমেন্ট একটা পরীক্ষার আয়োজন করে। এ পরীক্ষায় দুটি ক্ষুধার্ত দলকে একটি ধাঁধা সমাধান করতে দেয়া হয়। পার্থক্য হচ্ছে, একদলকে কিছু বিস্কুট পরিবশন করা হয়েছিলো। বলা হলো, বিস্কুট আপনাদের সামনে থাকবে, কিন্তু আপনার ধাঁধা সমাধান না করে খেতে পারবেন না। ফলাফল সহজেই অনুমেয়, যাদের সামনে বিস্কুট রাখা হয়নি, তারাই আগে ধাঁধা সমাধান করে ফেলে।

কাগুজে বই পড়ুন


ভাল লাগলে শেয়ার করে সবাইকে জানান

COMMENTS